সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

মধ্যযুগে ভেনিসিয়ান ডুকাটের মাধ্যমে বাণিজ্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছিল!!


মধ্যযুগের বাণিজ্য (Artist :- Unknown)

মুদ্রা সংগ্রহ এবং সংরক্ষণের নেশা বহু মানুষেরই রয়েছে। সেই মুদ্রা সংগ্রহ কেউ মিন্ট মার্ক অথবা কেউ ইতিহাসের সময়কাল ধরে করে থাকেন। বিশেষ করে যারা বিদেশ ভ্রমণে যান, ভ্রমণের পর, অবশিষ্ট বৈদেশিক অর্থ মানি এক্সচেঞ্জের অফিসে পরিবর্তন করে থাকেন। তবে ইতিহাস পর্যালোচনা করলে লক্ষ্য করা যায়, প্রাচীন সময়ে বৈদেশিক অর্থ বিনিময় একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা রূপে পরিচিত ছিল। বিশেষ করে মধ্যযুগে যখন নতুন নতুন ভূখণ্ড আবিষ্কার হতে থাকে তখন সেই সব ভূখন্ডের সম্পদের প্রতি মানুষের তীব্র আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদার জন্য ব্যাপকভাবে বাণিজ্য শুরু হয়, এবং মধ্যযুগের বাণিজ্যের দিক থেকে ভেনিস ছিল সকলের থেকে এগিয়ে, তাদের এক ধরনের বিশেষ মুদ্রা "ভেনেসিয়ান ডুকাট" ভারতেও প্রবেশ করেছিল ব্যাপক হারে। প্রধানত দক্ষিণ ভারতে এই ডুকাট খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। 2011 সালে তিরুবনন্তপুরমের পদ্মনাভস্বামী মন্দিরের যখন গুপ্ত ভল্ট গুলির একটি খোলা হয়েছিল, তখন সেখানে অন্যান্য ধন-সম্পদের সাথে ব্যাপকভাবে সোনার ডুকাট পাওয়া গিয়েছিল। 

কিন্তু কী ভাবে ভিনিসিয়ান ডুকাট এত মূল্যবান হয়েছিল আজ সেই গল্পই আপনাদের বলব।

মধ্যযুগে একাদশ থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত ক্রুসেড চলেছিল, সেই সময় ইউরোপের ভাগ্যে একটি নাটকীয় পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল, একই সাথে বহু বাণিজ্য রাষ্ট্রের উত্থান ঘটে। তাদের মধ্যে ভেনিসীয় বণিকরা  ইউরোপে প্রভাবশালী ও অর্থবান ছিলেন। এই শহরটি মার্কোপোলোর মতো বহু মহান ইউরোপীয় অভিযাত্রীদের জন্মস্থানও ছিল,যাঁরা একই সাথে বহুবার ভ্রমণ এবং বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সাথে সফল হয়েছিলেন। এইভাবে, ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষের দিকে, ভেনিসের বণিক সমূহ ভূমধ্যসাগর জুড়ে বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম ছিলেন।
ভেনিসিয়ান বণিকরা জানত যদি বিশ্ব বাণিজ্যের উপর তাদের শক্তি ও প্রভাবকে একত্রিত করতে হয়, তবে তাদের এমন একটি মুদ্রার প্রয়োজন হবে যা সমস্ত জাতি গ্রহণ করবে এবং এই ধরনের মুদ্রার মাধ্যমে বাণিজ্য অবাধে সম্প্রসারিত হবে। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে  অর্থ প্রদানের সুবিধার জন্য তাঁদের হাত ধরেই উঠে এসেছিল ডুকাট। ডুকাটের জনপ্রিয়তা শীঘ্রই বহুদূরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং এটি ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, ভারত, মিশর এবং আফ্রিকার বাজার খুব সহজেই দখল করে নেয়। ভেনেসিয়ানরা এই মুদ্রার মান, ওজন, বিশুদ্ধতা এবং নকশা বিশ্বের যেকোনো জাতিকে অন্যের সাথে বাণিজ্য করার অনুমতি দেয়, এবং খুব সহজেই অর্থ আদান প্রদানের একটি অভিন্ন পদ্ধতি গঠন করে। সময়ের সাথে সাথে ভেনিসিয়ান ডুকাট সকলের পছন্দের আন্তর্জাতিক মুদ্রা হয়ে উঠতে বেশি সময় লাগেনি। ডুকাট' শব্দটি এসেছে ল্যাটিন ' ডুকাটাস ' থেকে, যার অর্থ হল 'প্রত্যেকে ডিউকের সাথে সম্পর্কিত'। খুব সহজ ভাষায় এর অর্থ 'ডিউকের মুদ্রা'। 

মধ্যযুগের ভেনিসিয়ান ডুকাট (Indian Museum's Collection)

ভেনিসের প্রথম ডুকাট তৈরি হয় রাজা দ্বিতীয় রজারের সময়, সময়টা ছিল ১১৪০ খ্রিস্টাব্দ, সেই সময় তিনি ইতালির আপুলিয়ার ডিউক ছিলেন। এই প্রথম তৈরি ডুকাট এর সামনের দিকে, রাজা দ্বিতীয় রজারের ছবি এর ছবি বর্তমান। সেখানে লক্ষ্য করা যায় সেন্ট মার্কের হাতে একটি গসপেল রয়েছে এবং তাঁর সামনে রাজা হাঁটু গেড়ে বসে আছেন, বিপরীত দিকে, যীশু খ্রীষ্ট একটি ডিম্বাকৃতি ফ্রেমে তারার একটি ক্ষেত্রের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন এবং সেখানে লেখা আছে, 'সিট টিবি, ক্রিস্টে ওয়াই, ডাটাস, কেম তু রেজিস ইস্তে ডুকাটাস' 'এর অর্থ 'হে প্রভু আপনার শাসন সর্বত্র বর্তমান এবং আমার সবকিছু আপনাকে উৎসর্গ করছি। প্রথমদিকে সোনা ও রুপা দিয়ে তৈরি দুই ধরনের মুদ্রা কি ডুকাট বলা হত। পরের দিকে শুধুমাত্র সোনা দিয়ে তৈরি মুদ্রা গুলোই ডুকাট নামে বেশি জনপ্রিয় হয়ে যায়। এরপর রুপা দিয়ে যে সকল মুদ্রা গুলি তৈরি হতো তার নাম পরিবর্তন হয়ে হল "গ্রসি"। ডন জিওভান্নি ডানডোলোর সময়ে আমরা এক নতুন ধরনের ডুকাট লক্ষ্য করে থাকি, সময়টা 1284 সাল, সেই সময় ভেনিসে 3.5 গ্রামের খাঁটি সোনা দ্বারা নির্মিত এবং সূক্ষ্মতায় পরিপূর্ণ এক ধরনের নতুন ডুকাট তৈরি করা হয়েছিল, এটি বিশুদ্ধতা এবং সূক্ষ্মতার দিক থেকে অন্যতম ছিল। 1797 সালে ভেনিসের প্রজাতন্ত্রের শেষ অধ্যায় পর্যন্ত এই মুদ্রা দিয়েই বাণিজ্য চলতো।
1797 সালে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের ভেনিস আক্রমণের পর এই মুদ্রার আন্তর্জাতিক গুরুত্ব হ্রাস পায়।
চতুর্দশ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যে, ভেনিস এবং দক্ষিণ ভারতের মধ্যে বাণিজ্যিক প্রসার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল, বিশেষ করে কেরল এবং তামিলনাড়ুতে ফ্রান্সিস লরেন্ডানো, পল রেইনিয়ার ও পিটার গ্রিমনি দ্বারা জারি করা সোনার ডুকাট ব্যবহৃত হতো।  মধ্যযুগীয় কেরালায় এই ভেনিসীয় মুদ্রাগুলির প্রচুর চাহিদা ছিল এবং ভারতীয় শাসকরা পুরোহিত এবং পণ্ডিতদের উপহার হিসাবে সেগুলি দিয়ে থাকতেন।
যেহেতু সেই মুদ্রায় সেন্ট মার্কের চিত্র থাকতো, তাই এই মুদ্রাগুলি কেরালার খ্রিস্টানদের কাছে পবিত্র বলে বিবেচিত হয়েছিল এবং অনেক খ্রিস্টান মহিলা সেই সময় ভিনিসীয় মুদ্রা দিয়ে তৈরি গলার মালা পরতেন। এই কারণেই বহু ডুকাটের মধ্যে ছোট ছিদ্র লক্ষ্য করা যায়। ভারতে, ডুকাট গহনা ছাড়াও যৌতুক হিসাবে বিনিময় ফটো।
ভারতের অন্যান্য স্থানেও ভেনিসীয় স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া যায়। 1981 সালে, কর্ণাটকের প্রত্নতত্ত্ব ও জাদুঘর অধিদপ্তর বার্থোলোমিউ গ্রেডেনিগো (1339-1341 খ্রিষ্টাব্দ) থেকে থমাস মোসেনিগো (1414-1423 খ্রিষ্টাব্দ) পর্যন্ত প্রায় 9টি ডোজের 39টি ভেনিসিয়ান ডুকাটের সন্ধান পেয়েছিলেন।
অতি সম্প্রতি, অক্টোবর 2018-এ, ভিনিসিয়ান ডুকাট অন্যান্য আকর্ষণীয় মুদ্রার সাথে NCPA, মুম্বাই-এ প্রদর্শিত হয়েছিল। এটি আজ শুধুমাত্র সংগ্রাহকদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলেও ইতিহাসে এই মুদ্রা এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

কলমে :- Monojit Dey Sarkar 


মন্তব্যসমূহ

  1. Outstanding Post !!!! লেখার গুণগত মান অসাধারণ, আরো নতুন তথ্যের অপেক্ষায় রইলাম।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আপনি কি জানেন !! ভারতের পবিত্র পূণ্য ক্ষেত্রে রয়েছে এক ব্রিটিশ সমাধি।

   লর্ড কর্নওয়ালিসের প্রতিকৃতি (British Museum's Collectio n) আমরা যারা ইতিহাস চর্চা করি, 'লর্ড কর্নওয়ালিস' এই নামটির সাথে সকলেই বিশেষভাবে পরিচিত।  ভারতের পবিত্র পূণ্য ক্ষেত্র বেনারস থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গাজীপুর, এই স্থানে ব্রিটিশ গর্ভনর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিসের সমাধিটি অবস্থিত রয়েছে। ইতিহাস বলে কর্নওয়ালিস সাহেব আমেরিকার প্রথম রাষ্ট্রপতি জর্জ ওয়াশিংটনের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন। কিন্তু তার এই পরাজয় জীবনকে থামিয়ে দেয় নি বরং পরবর্তীতে ভারতে বহু যুদ্ধে জয়লাভ করতে সাহায্য করেছিল। অনেক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্যে তিনি ব্রিটিশ সরকারের একজন শক্তিশালী প্রতিনিধি হতে পেরেছিলেন। ভারতের বেনারস বা বারাণসীতে তাঁর সমাধিটি লাড সাহাব বা লাত সাহাব বা লর্ড সাহাব কা মাকবারা নামে পরিচিত। আমেরিকাতে যুদ্ধে পরাজয়ের পর তিনি ভারতবর্ষে আসেন। ১৭৮৬ সালে ভারতে লর্ড কর্নওয়ালিস দ্বিতীয় গভর্নর জেনারেল এবং কমান্ডার-ইন-চীফ হিসেবে কর্মে যোগদান করেছিলেন। খুব দক্ষতা এবং কৌশলের মাধ্যমে তিনি ব্রিটিশদের সম্পর্কে ভারতবাসীর তীব্র ঘৃণাটাকে কিছুটা হলেও দূর করবার চেষ্টা করেছিলেন এবং নিজ

পৃথিবীর হারিয়ে যাওয়া গ্রন্থাগার সমূহের ইতিহাস!!

আমরা প্রাচীন যুগ থেকেই বিভিন্নভাবে তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছি এবং তার ই তাগিদে প্রাচীন বিশ্বে বহু গ্রন্থাগার গড়ে উঠেছিল। বিভিন্ন সময়ে মানুষের উদ্যোগে গ্রন্থাগার গুলি পূর্ণতা পেয়েছিল। আজকে আমরা সেই সকল গ্রন্থাগার এবং তাদের হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করব।  1. আশুরবানিপালের গ্রন্থাগার অ্যাসিরিয় সভ্যতায় রাজা আশুরবানিপালের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। নব্য-অ্যাসিরিয়ান সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন আশুরবানীপাল। খ্রিস্টপূর্ব ৬৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৬৩১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত তার সময়কাল ছিল বলে মনে করেন ঐতিহাসিকগণ, এবং তাঁকে আসিরীয়ার শেষ মহান রাজা হিসেবেও স্মরণ করা হয়ে থাকে। আশুরবানিপাল তার পিতা এসারহাদ্দনের পর উত্তরাধিকারী সূত্রে সিংহাসন লাভ করেছিলেন, তার ৩৮ বছরের রাজত্বকালে তিনি বহু যুদ্ধে জয়লাভ করে এবং আসিরীয় সভ্যতায় এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় তিনি সৃষ্টি করেছিলেন। ৭ম শতাব্দীতে আশুরবানিপালের "রাজকীয় চিন্তাভাবনার" জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই প্রাচীন গ্রন্থাগার এবং গ্রন্থাগারটি আধুনিক দিনের ইরাকের নিনেভেতে অবস্থিত ছিল।প্রত্নতাত্ত্