সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

আপনি কি জানেন !! ভারতের পবিত্র পূণ্য ক্ষেত্রে রয়েছে এক ব্রিটিশ সমাধি।

  

লর্ড কর্নওয়ালিসের প্রতিকৃতি (British Museum's Collectio
n)
আমরা যারা ইতিহাস চর্চা করি, 'লর্ড কর্নওয়ালিস' এই নামটির সাথে সকলেই বিশেষভাবে পরিচিত। 

ভারতের পবিত্র পূণ্য ক্ষেত্র বেনারস থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গাজীপুর, এই স্থানে ব্রিটিশ গর্ভনর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিসের সমাধিটি অবস্থিত রয়েছে।

ইতিহাস বলে কর্নওয়ালিস সাহেব আমেরিকার প্রথম রাষ্ট্রপতি জর্জ ওয়াশিংটনের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন। কিন্তু তার এই পরাজয় জীবনকে থামিয়ে দেয় নি বরং পরবর্তীতে ভারতে বহু যুদ্ধে জয়লাভ করতে সাহায্য করেছিল। অনেক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্যে তিনি ব্রিটিশ সরকারের একজন শক্তিশালী প্রতিনিধি হতে পেরেছিলেন। ভারতের বেনারস বা বারাণসীতে তাঁর সমাধিটি লাড সাহাব বা লাত সাহাব বা লর্ড সাহাব কা মাকবারা নামে পরিচিত। আমেরিকাতে যুদ্ধে পরাজয়ের পর তিনি ভারতবর্ষে আসেন। ১৭৮৬ সালে ভারতে লর্ড কর্নওয়ালিস দ্বিতীয় গভর্নর জেনারেল এবং কমান্ডার-ইন-চীফ হিসেবে কর্মে যোগদান করেছিলেন। খুব দক্ষতা এবং কৌশলের মাধ্যমে তিনি ব্রিটিশদের সম্পর্কে ভারতবাসীর তীব্র ঘৃণাটাকে কিছুটা হলেও দূর করবার চেষ্টা করেছিলেন এবং নিজেকে একজন সফল গভর্নর ও সমাজ সংস্কারক হিসেবে পরিচিত করবার চেষ্টায় তিনি সর্বদা নিয়োজিত ছিলেন। 

১৭৮৬ সাল থেকে ১৭৯৩ সালের এর অক্টোবর পর্যন্ত তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সেই সময় ১৭৯০ থেকে ১৭৯২ সালে তিনি মহীশুরের যুদ্ধে ব্রিটিশদের হয়ে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন। প্রায় ২ বছর ধরে মহীশুরের শাসকদের সাথে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর যুদ্ধ চলে। টিপু সুলতানের সাথে যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বহু কঠিন সময় পার করতে হয়েছিল। কারণ টিপু সুলতান একজন সুদক্ষ যোদ্ধা ছিলেন।

যে কারণে লর্ড কর্নওয়ালিস টিপুর সুলতানের সাথে যুদ্ধের আগে তাঁর সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করে মাঠে নেমেছিলেন এবং নিজাম এবং মারাঠা বাহিনীকে সাথে নিয়ে তিনি যুদ্ধে জয়লাভ করেছিলেন।

যুদ্ধে জয়লাভ করে কর্নওয়ালিস শ্রী রাঙ্গাপত্তনমে এক চুক্তিতে স্বাক্ষর করান টিপু সুলতানকে। সেই সময় ব্রিটিশরা টিপুর রাজত্বের অনেকটা অংশই দখল করে নিয়েছিল। শুধু এখানেই থেমে থাকেননি লর্ড কর্নওয়ালিস, এরপর টিপু সুলতানের ছেলেদেরকেও জিম্মি করে ৩ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় করেন। 

তবে অত্যন্ত চালাক এই গভর্নর জেনারেল মারাঠা এবং নিজামদের সাথে নিলেও তাদেরকে খুব একটা এগোনোর সুযোগ দেননি। তার রণনীতি যেমন শত্রুপক্ষকে পরাজিত করে একইভাবে কিন্তু মিত্রপক্ষকেও শক্তিশালী হতে দেয়নি। এই ঐতিহাসিক যুদ্ধ তাঁর আত্নবিশ্বাসকে আরও দ্বিগুণভাবে বাড়িয়ে তুলেছিল। এরপর থেকে তার ভাগ্য আরো প্রশমিত হয়, এবং ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের কাছে তার ভাবমূর্তি আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে তিনি রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কার আনার কাজে সচেষ্ট হন। লর্ড কর্নওয়ালিস ব্রিটিশ গভর্নর রূপে ভূমি সংস্কার এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কার সাধন করেন। শুধু এখানেই শেষ নয়  তিনি দুবার ভারতের গভর্নর জেনারেল রূপে নিযুক্ত হয়ে কালেক্টরদের অধিকার এবং তাদের বেতন নির্ধারণের পাশাপাশি পুলিশ ব্যবস্থায় এক নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন। এই কারণে তাকে পুলিশ ব্যবস্থার জনকও বলা হয়ে থাকে।  ১৭৯৩ সালের মাঝামাঝি একটি আইন প্রনয়ণ করেন লর্ড কর্নওয়ালিস। যা "কর্নওয়ালিস কোড" নামে পরিচিত, এর মাধ্যমে তিনি নির্বাহী ও বিচার বিভাগের ক্ষমতাকে আলাদা করেছিলেন। এরপর ১৭৯৭ সালে ফৌজদারি আইন সংশোধন করে তিনি একটি আইন পাস করেন  এছাড়া প্রশাসনিক ব্যবস্থার উন্নতির জন্য তিনি ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটকে পুলিশের দায়িত্ব দেন। এর পরে পরেই জমিদারি সংক্রান্ত একটি বিল তিনি পাস করেন, যা সেই সময়ে সমাজকে বিশেষভাবে সংস্কার করেছিল। যখন এদেশে তার প্রথম মেয়াদ শেষ হয়েছিল তখন তিনি নিজ দেশে ফেরত যান তারপরে তার জায়গায় আসেন লর্ড ওয়েলেসলি। লর্ড ওয়েলেসলির সময়কালে ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসন অত্যন্তভাবে অর্থনৈতিক চাপ এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার মুখোমুখি হয়। এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাবার জন্যে ১৮০৫ সালের জুলাই মাসে আবার লর্ড কর্নওয়ালিসকে দ্বিতীয়বারের জন্যে ভারতে নিয়ে আসা হয়। 


সমাধি ক্ষেত্রের সেকাল ও একাল

দ্বিতীয় মেয়াদের কিছু সময়ের মধ্যেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ১৮০৫ সালের ৫ অক্টোবর তিনি যখন পূর্বাঞ্চল সফরে ছিলেন তখন আকস্মিকভাবে তার মৃত্যু ঘটে, মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল মাত্র ৬৭ বছর। গাজীপুরে তাঁর মৃত্যুর পর কলকাতায় বসবাসকারী ব্রিটিশরা তার স্মরণে গাজীপুরে এক বিশাল স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেন। গাজীপুরে প্রায় ৬ একর জমির উপরে তৈরি এই স্মৃতিস্তম্ভটি ব্রিটিশ স্থাপত্যের এক অন্যতম নিদর্শন। 

সমাধি ক্ষেত্রের অলংকরণ

এই স্মৃতিসৌধের ভিতরের অংশে রয়েছে লর্ড কর্নওয়ালিসের সমাধিটি। সাদা মার্বেল পাথরের দ্বারা নির্মিত প্রায় ৩.৬৬ মিটার উঁচু এক বেদী লক্ষ্য করা যায় এই সমাধিক্ষেত্রে। এই স্থাপত্যে ১২ টি পাথরের স্তম্ভের উপর একটি বড় গম্বুজের সাথে লর্ড কর্নওয়ালিসের সাদা মার্বেল পাথরের এক আবক্ষ মূর্তি নির্মাণ করা রয়েছে। বিশেষ করে তাঁর এই বেদীর দুই পাশে লক্ষ্য করা যায় একজন ব্রাহ্মণ, সুলতান, ইংরেজ এবং সৈনিককে যাঁরা শোক প্রকাশের ভঙ্গিমায় রয়েছেন। পদ্ম ফুল, কুঁড়ি, পাতার চমৎকার খোদাই কারুকার্য সেখানে দেখতে পাওয়া যায়। ইংরেজি এবং উর্দু (ফার্সি) ভাষায় কর্নওয়ালিসের সাফল্যের গাঁথা লেখা রয়েছে তাঁর সেই সমাধিতে। লর্ড কর্নওয়ালিস একজন সুদক্ষ ব্রিটিশ প্রশাসক ছিলেন। ভারতবর্ষ শাসন করতে এসে  মৃত্যুবরণ করেন। হতভাগ্য এই শাসক পারেননি নিজের দেশের মাটিতে ফিরে যেতে, চিরকালের মতো এখানেই শায়িত হয়েছেন, হয়তো এই ভাগ্যের পরিহাসকেই ইতিহাসের ট্রাজেডি বলে, উত্তরটা আমাদের জানা নেই। বর্তমানে এই ঐতিহাসিক স্থানটির দেখাশোনার দায়িত্বে রয়েছেন উত্তরপ্রদেশ সরকার, ভবিষ্যতে বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান যাতে আরো ভালোভাবে সংরক্ষণ করা যায় সেদিকেও তাঁরা নজর রেখেছেন। যারা বেনারস ভ্রমণের কথা ভাবছেন তারা এই স্থানটি দেখতে ভুলবেন না কিন্তু, পরিবারের সাথে এমন এক ঐতিহাসিক স্থানে ভ্রমণ রোমাঞ্চকর পরিবেশ তৈরি করবে। 


কলমে :- Monojit Dey Sarkar 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

মধ্যযুগে ভেনিসিয়ান ডুকাটের মাধ্যমে বাণিজ্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছিল!!

মধ্যযুগের বাণিজ্য (Artist :- Unknown) মুদ্রা সংগ্রহ এবং সংরক্ষণের নেশা বহু মানুষেরই রয়েছে। সেই মুদ্রা সংগ্রহ কেউ মিন্ট মার্ক অথবা কেউ ইতিহাসের সময়কাল ধরে করে থাকেন। বিশেষ করে যারা বিদেশ ভ্রমণে যান, ভ্রমণের পর, অবশিষ্ট বৈদেশিক অর্থ মানি এক্সচেঞ্জের অফিসে পরিবর্তন করে থাকেন। তবে ইতিহাস পর্যালোচনা করলে লক্ষ্য করা যায়, প্রাচীন সময়ে বৈদেশিক অর্থ বিনিময় একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা রূপে পরিচিত ছিল। বিশেষ করে মধ্যযুগে যখন নতুন নতুন ভূখণ্ড আবিষ্কার হতে থাকে তখন সেই সব ভূখন্ডের সম্পদের প্রতি মানুষের তীব্র আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদার জন্য ব্যাপকভাবে বাণিজ্য শুরু হয়, এবং মধ্যযুগের বাণিজ্যের দিক থেকে ভেনিস ছিল সকলের থেকে এগিয়ে, তাদের এক ধরনের বিশেষ মুদ্রা "ভেনেসিয়ান ডুকাট" ভারতেও প্রবেশ করেছিল ব্যাপক হারে। প্রধানত দক্ষিণ ভারতে এই ডুকাট খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। 2011 সালে তিরুবনন্তপুরমের পদ্মনাভস্বামী মন্দিরের যখন গুপ্ত ভল্ট গুলির একটি খোলা হয়েছিল, তখন সেখানে অন্যান্য ধন-সম্পদের সাথে ব্যাপকভাবে সোনার ডুকাট পাওয়া গিয়েছিল।  কিন্তু কী ভাবে ভিনিসিয়ান ডুকাট এত মূল্যবান হয়েছিল আজ সেই গল্পই আপ

পৃথিবীর হারিয়ে যাওয়া গ্রন্থাগার সমূহের ইতিহাস!!

আমরা প্রাচীন যুগ থেকেই বিভিন্নভাবে তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছি এবং তার ই তাগিদে প্রাচীন বিশ্বে বহু গ্রন্থাগার গড়ে উঠেছিল। বিভিন্ন সময়ে মানুষের উদ্যোগে গ্রন্থাগার গুলি পূর্ণতা পেয়েছিল। আজকে আমরা সেই সকল গ্রন্থাগার এবং তাদের হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করব।  1. আশুরবানিপালের গ্রন্থাগার অ্যাসিরিয় সভ্যতায় রাজা আশুরবানিপালের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। নব্য-অ্যাসিরিয়ান সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন আশুরবানীপাল। খ্রিস্টপূর্ব ৬৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৬৩১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত তার সময়কাল ছিল বলে মনে করেন ঐতিহাসিকগণ, এবং তাঁকে আসিরীয়ার শেষ মহান রাজা হিসেবেও স্মরণ করা হয়ে থাকে। আশুরবানিপাল তার পিতা এসারহাদ্দনের পর উত্তরাধিকারী সূত্রে সিংহাসন লাভ করেছিলেন, তার ৩৮ বছরের রাজত্বকালে তিনি বহু যুদ্ধে জয়লাভ করে এবং আসিরীয় সভ্যতায় এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় তিনি সৃষ্টি করেছিলেন। ৭ম শতাব্দীতে আশুরবানিপালের "রাজকীয় চিন্তাভাবনার" জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই প্রাচীন গ্রন্থাগার এবং গ্রন্থাগারটি আধুনিক দিনের ইরাকের নিনেভেতে অবস্থিত ছিল।প্রত্নতাত্ত্