সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

পৃথিবীর হারিয়ে যাওয়া গ্রন্থাগার সমূহের ইতিহাস!!


আমরা প্রাচীন যুগ থেকেই বিভিন্নভাবে তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছি এবং তার ই তাগিদে প্রাচীন বিশ্বে বহু গ্রন্থাগার গড়ে উঠেছিল। বিভিন্ন সময়ে মানুষের উদ্যোগে গ্রন্থাগার গুলি পূর্ণতা পেয়েছিল। আজকে আমরা সেই সকল গ্রন্থাগার এবং তাদের হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করব। 


1. আশুরবানিপালের গ্রন্থাগার


অ্যাসিরিয় সভ্যতায় রাজা আশুরবানিপালের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। নব্য-অ্যাসিরিয়ান সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন আশুরবানীপাল। খ্রিস্টপূর্ব ৬৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৬৩১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত তার সময়কাল ছিল বলে মনে করেন ঐতিহাসিকগণ, এবং তাঁকে আসিরীয়ার শেষ মহান রাজা হিসেবেও স্মরণ করা হয়ে থাকে। আশুরবানিপাল তার পিতা এসারহাদ্দনের পর উত্তরাধিকারী সূত্রে সিংহাসন লাভ করেছিলেন, তার ৩৮ বছরের রাজত্বকালে তিনি বহু যুদ্ধে জয়লাভ করে এবং আসিরীয় সভ্যতায় এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় তিনি সৃষ্টি করেছিলেন। ৭ম শতাব্দীতে আশুরবানিপালের "রাজকীয় চিন্তাভাবনার" জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই প্রাচীন গ্রন্থাগার এবং গ্রন্থাগারটি আধুনিক দিনের ইরাকের নিনেভেতে অবস্থিত ছিল।প্রত্নতাত্ত্বিকবিদরা খনন কার্য চালিয়ে প্রায় ৩০০০০ কিউনিফর্ম লিপি উদ্ধার করেন। এগুলির বেশিরভাগ ই ছিল আর্কাইভাল নথি, ধর্মীয় মন্ত্র, এছাড়া ৪০০০ বছরের পুরনো "গিলগামেশের মহাকাব্য" সহ সাহিত্যের বেশ কিছু কাজও এর মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। বইপ্রেমী আশুরবানিপাল তাঁর গ্রন্থাগারকে বিভিন্ন বই দ্বারা সমৃদ্ধ করেছিলেন, যখন তিনি নতুন কোন রাজ্য জয় করতেন সেই রাজ্যের গ্রন্থাগারের বইগুলি তাঁর ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারে খুব গর্বের সাথে স্থান পেতো। প্রত্নতাত্ত্বিকরা ১৯ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ধ্বংসাবশেষ থেকে বহু লিপি উদ্ধার করেছিলেন এবং বর্তমানে সেগুলি এখন লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত হয়েছে। আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, আশুরবানিপাল তাঁর একটি লিপিতে সতর্ক করে একটা বার্তা দিয়েছিলেন,  কেউ যদি এই লিপি গুলি চুরি করে তাহলে দেবতারা "তাকে অগ্নিতে নিক্ষেপ করবেন" এবং "ভূমিতে তার নাম ও সন্তানদের মুছে দেবেন।"


2. আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার


৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের মৃত্যুর পর, মিশরের নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণভাবে প্রথম টলেমি সোটারের হাতে চলে যায়, যিনি আলেকজান্দ্রিয়া শহরকে শিক্ষার কেন্দ্র রূপে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, এবং এর ফল স্বরূপ গড়ে উঠেছিল আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার, যা ধীরে ধীরে সেই সময়ের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানপীঠ হয়ে ওঠে। এই গ্রন্থাগারের অন্দরমহল সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়, তবে এই গ্রন্থাগারে ইতিহাস, আইন, গণিত, বিজ্ঞানে ও সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়কে কেন্দ্র করে প্রায় পাঁচ লক্ষেরও বেশি প্যাপিরাস স্ক্রোল ছিল। এই গ্রন্থাগার এবং গ্রন্থাগারে বিভিন্ন গবেষণার বিষয় ভূমধ্যসাগরের আশেপাশের পণ্ডিতদের আকৃষ্ট করেছিল, যারা গ্রন্থাগারের মধ্যে সর্বদা গবেষণা, পরিচালনা এবং বিভিন্ন বিষয়বস্তু অনুলিপি করতেন তাঁরা সকলেই সরকারী উপবৃত্তি পেতেন। বিভিন্ন সময়ে, স্ট্র্যাবো, ইউক্লিড এবং আর্কিমিডিসের মত মহান ব্যক্তিরা এই গ্রন্থাগারের সাথে যুক্ত ছিলেন। অসাধারণ এই গ্রন্থাগারের মৃত্যু ঐতিহ্যগতভাবে ৪৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হয়েছিল, যখন মিশরীয় শাসক ত্রয়োদশ টলেমির সাথে জুলিয়াস সিজারের যুদ্ধ হয়। এই ঘটনাক্রমে আলেকজান্দ্রিয়ার বন্দরে আগুন লাগানোর কারণে গ্রন্থাগারটি পুড়ে যায়। কিন্তু এই ঘটনার পরেও বহু ইতিহাসবিদ বিশ্বাস করেন যে গ্রন্থাগারটি আরও কয়েক শতাব্দী ধরে বিদ্যমান ছিল। কিছু ইতিহাসবিদ যুক্তি দেন যে এই বিখ্যাত গ্রন্থাগারটি ২৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাট অরেলিয়ানের শাসনকালে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল।


3. পারগামুমের লাইব্রেরি


খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে আটালিদ রাজবংশের সদস্যদের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল পারগামুমের গ্রন্থাগার। এই গ্রন্থাগারের ধ্বংসস্তূপ বর্তমানে তুরস্কে অবস্থিত, একসময় প্রায় ২ লক্ষ স্ক্রোলের মাধ্যমে এই গ্রন্থাগারটি সমৃদ্ধ ছিল। গ্রন্থাগারটি গ্রীক জ্ঞানের দেবী এথেনার প্রতি উৎসর্গীকৃত একটি মন্দিরের অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং প্রত্নতাত্ত্বিকরা বিশ্বাস করেন সেই সময় এই গ্রন্থাগারে চারটি কক্ষ ছিল। - তিনটি কক্ষ গ্রন্থাগারের অধ্যয়নের কাজে এবং অন্য একটি কক্ষ, শিক্ষা সম্মেলনের জন্য ব্যবহৃত হতো। প্লিনি দ্য এল্ডারের মত অনুসারে, পারগামুমের গ্রন্থাগারটি শেষ পর্যন্ত এতটাই বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল যে এটি আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারের সাথে "তীক্ষ্ণ প্রতিদ্বন্দ্বিতায়" যুক্ত হয়েছিল। উভয় গ্রন্থাগার প্রাচীন সময়ে নিজেদের এক বিশেষ গুরুত্ব তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। এমনকি একটি কিংবদন্তি রয়েছে যে মিশরের টলেমাইক রাজবংশ পারগামুমে প্যাপিরাস এর রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছিল। ফলস্বরূপ, পার্চমেন্ট পেপারের মাধ্যমে গ্রন্থাগারটি আবার জনপ্রিয়তা লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল। ১১০৯ থেকে ১১১৩ খ্রিস্টাব্দে বহিঃশত্রুর বারংবার আক্রমণের ফলে এই গ্রন্থাগার ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।


4. প্যাপিরির ভিলা


ঐতিহাসিকদের মতে "প্যাপিরির ভিলা" প্রাচীনকালের বৃহত্তম গ্রন্থাগার ছিল না। তবে এই গ্রন্থাগারের প্রায় ১৮০০টি স্ক্রোল আজও বর্তমান রয়েছে। রোমান শহর হারকিউলেনিয়ামে একটি ভিলায় অবস্থান করছে এই স্ক্রোলগুলি, ১৭৫০ সালে এই স্ক্রোলগুলির‌ খোঁজ মিলেছিল। ঐতিহাসিকদের মতে এগুলি লুসিয়াস ক্যালপুরনিয়াস পিসো সিসোনিনাসের নিজস্ব ব্যক্তিগত সংগ্রহ ছিল । একটা কথা এখানে বলে রাখা উচিত তিনি কিন্তু সম্পর্কে ছিলেন জুলিয়াস সিজারের শ্বশুরমশাই ছিলেন।

৭৯ খ্রিস্টাব্দে মাউন্ট ভিসুভিয়াসে অগ্ন্যুৎপাত হয়েছিল, তখন গ্রন্থাগারটি আগ্নেয় উপাদানের ৯০ ফুট স্তরের নীচে সমাধিস্থ হয়েছিল এবং এমনভাবে সংরক্ষিত ছিল যাকে ইতিহাসে এক প্রকার চমৎকার বলা যেতে পারে ৷ এরপর কালো, কার্বনাইজড স্ক্রোলগুলি 18 শতক পর্যন্ত পুনঃআবিষ্কৃত হয়নি এবং বর্তমানে আধুনিক গবেষকরা সেগুলি পড়ার চেষ্টা করার জন্য মাল্টিস্পেকট্রাল ইমেজিং থেকে এক্স-রে পর্যন্ত সবকিছু ব্যবহার করেছেন। তবে ক্যাটালগের বেশিরভাগই এখনও পাঠোদ্ধার করা হয়নি, কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গেছে যে লাইব্রেরিতে ফিলোডেমাস নামে একজন এপিকিউরিয়ান দার্শনিকের বেশ কয়েকটি পাঠ রয়েছে।


5. ট্রাজানের গ্রন্থাগার 

প্রায় ১১২ খ্রিস্টাব্দের কোনো এক সময়ে, সম্রাট ট্রাজান রোম শহরের কেন্দ্রস্থলে একটি বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে একটি ভবন নির্মাণ সম্পন্ন করেন। এই ভবনটিকে এখনকার দিনের প্লাজা বা শপিং মল বলা যেতে পারে। বিশেষত বাজার ও ধর্মীয় মন্দির এই স্থানের গর্ব ছিল। রোমান সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থাগারটিও এই ভবনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল। এখানে দুর্দান্তভাবে ল্যাটিন এবং গ্রীক ভাষার চর্চা করা হতো। কক্ষগুলির একটি পোর্টিকোর বিপরীত দিকে অবস্থিত ছিল যেখানে সম্রাটের সামরিক সাফল্যের সম্মানে নির্মিত একটি বড় স্মৃতিস্তম্ভ এখানে লক্ষ্য করা যেত। সকল বিভাগই কংক্রিট, মার্বেল এবং গ্রানাইট দ্বারা সুন্দরভাবে তৈরি করা ছিল এবং সেগুলির মধ্যে বৃহৎ কেন্দ্রীয় পাঠ কক্ষ এবং আনুমানিক কুড়ি হাজার স্ক্রোল ধারণকারী দুটি স্তরের আলমারি এই গ্রন্থাগারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ট্রাজানের এই গ্রন্থাগারের অস্তিত্ব কখন সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে যায় সে সম্পর্কে ঐতিহাসিকরা এখনো নিশ্চিত নন, তবে এই গ্রন্থাগার সম্বন্ধে মনে করা হয় এটি কমপক্ষে ৩০০ বছর ধরে সফলতা পেয়েছিল।


6. সেলসাসের গ্রন্থাগার


রোম সাম্রাজ্যের সময়কালে শহরে দুই ডজনেরও বেশি প্রধান গ্রন্থাগার ছিল, কিন্তু রাজধানীই একমাত্র স্থান ছিল না যেখানে সাহিত্যের চমকপ্রদ সংগ্রহ ছিল। প্রায় ১২০ খ্রিস্টাব্দের রোমান কনসাল টাইবেরিয়াস জুলিয়াস সেলসাস পোলেমেয়ানাস ইফেসাস প্রাচীন তুরস্ক শহরে তাঁর পিতার স্মৃতির জন্য একটি গ্রন্থাগার তৈরি করেছিলেন। এই ভবনটির অলঙ্কৃত সম্মুখভাগ আজও দাঁড়িয়ে আছে এবং এখানে একটি মার্বেল সিঁড়ি লক্ষ্য করা যায় যার স্তম্ভের পাশাপাশি চারটি মূর্তি রয়েছে যেগুলি প্রজ্ঞা, গুণ, বুদ্ধিমত্তা এবং জ্ঞানের প্রতিনিধিত্ব করে। এই গ্রন্থাগারের ধ্বংসাবশেষের অভ্যন্তরে কোনের দিকে একটি বইয়ের আলমারি ধারণকারী ছোট কুলুঙ্গি লক্ষ্য করা যায়। এই গ্রন্থাগারে প্রায় ১২০০০ স্ক্রোল ছিল বলে ঐতিহাসিকগণ মনে করেন, গ্রন্থাগারের এটি সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য ছিল সেলসাস নিজেই। শুধুমাত্র তার কারণেই গ্রন্থাগারটি পূর্ণ রূপ পেতে সক্ষম হয়েছিল।


7. কনস্টান্টিনোপলের ইম্পেরিয়াল গ্রন্থাগার


পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পরে, বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপলে ক্লাসিকাল গ্রীক ও রোমান সংস্কৃতির চিন্তাধারা বিকাশ লাভ করতে থাকে। শহরের ইম্পেরিয়াল গ্রন্থাগারটি খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর অগ্রভাগে কনস্টানটাইন দ্য গ্রেটের সময়ে পূর্ণতা লাভ করে, পরে পঞ্চম শতাব্দীর শেষ ভাগে এই গ্রন্থাগার এক লক্ষ কুড়ি হাজার স্ক্রোল এবং কোডেসের মাধ্যমে সমৃদ্ধ হয়েছিল। ইম্পেরিয়াল গ্রন্থাগারের উত্তরসূরীদের অবহেলা এবং ঘন ঘন দাবানলের কারণে পরবর্তী কয়েক শতাব্দীতে এই গ্রন্থাগার দুর্বল হতে থাকে। পরে ১২০৪ সালে ক্রুসেডের সেনাবাহিনী কনস্টান্টিনোপলকে বিধ্বস্ত করার পরে এই গ্রন্থাগারও একটি বিধ্বংসী আঘাতের শিকার হয়। যুদ্ধের সময়ে বহু পন্ডিত গ্রন্থাগারের স্ক্রোল গুলিকে রক্ষা করেছিলেন তাঁরা ক্ষয়িষ্ণু প্যাপিরাস স্ক্রোলগুলির পার্চমেন্ট কপি তৈরি করেন, এবং আবার ধীরে ধীরে প্রাচীন গ্রীক ও রোমান সাহিত্যের পুনরায় বিকাশ ঘটতে থাকে।


8. বাগদাদ শিক্ষাকেন্দ্র


ইরাকি শহর বাগদাদ একসময় বিশ্বের শিক্ষা ও সংস্কৃতির অন্যতম কেন্দ্র ছিল। আব্বাসীয়দের শাসন আমলে খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীর প্রথম দিকে এই শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই শিক্ষা কেন্দ্রে গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, বিজ্ঞান, চিকিৎসা এবং দর্শনের উপর ফার্সি, ভারতীয় এবং গ্রীক পাণ্ডুলিপির সংগ্রহ ছিল। প্রত্যেকটি বই মধ্যপ্রাচ্যের শীর্ষ পণ্ডিতদের কাছে বিশেষ আকর্ষণ ছিল এবং তাঁরা প্রতিনিয়ত পাঠ্যগুলিকে অধ্যয়ন করতেন। সেই সময় বহু পণ্ডিত ব্যক্তিরা সেগুলিকে আরবীতে অনুবাদ করার জন্য এই শিক্ষা কেন্দ্রে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন। কিন্তু ১২৫৮ সালে যখন মঙ্গোলরা বাগদাদকে ধ্বংস করেছিল তখন এই শিক্ষাকেন্দ্র কে একটি ভয়াবহ পরিণতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল, । কিংবদন্তি অনুসারে, এত বেশিসংখ্যক বই মঙ্গোলরা টাইগ্রিস নদীতে ফেলে দিয়েছিল যে বইগুলির জল কালি থেকে কালো হয়ে গিয়েছিল।


৯. নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় 


নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়! এই নামের মাধ্যমে ভারতের প্রাচীন জ্ঞান কে আমরা উপলব্ধি করতে পারি। বিহারে অবস্থিত উচ্চ শিক্ষার এই প্রাচীন কেন্দ্রটি তক্ষশীলার পরে ভারতের দ্বিতীয় প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়। ১৪ হেক্টর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত, এটি খ্রিস্টপূর্ব শেষ শতাব্দী থেকে ১১৯৩ সাল পর্যন্ত শিক্ষার একটি প্রধান কেন্দ্র ছিল, যা পরবর্তী সময়েও তিব্বত, চীন, গ্রীস এবং পারস্য পর্যন্ত ছাত্রদের আকর্ষণ করেছিল। সাহিত্যের নথি এবং বিভিন্ন শিলালিপি অনুসারে জানা যায় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় গুপ্ত যুগে স্থাপিত হয়েছিল। বর্তমান প্রত্নতাত্ত্বিক খনন এবং আবিষ্কারগুলি প্রমাণ করে যে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের পরেও বিদ্যমান ছিল।

সেই সময় নালন্দা সহ সমস্ত প্রাচীন ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈদিক শিক্ষার ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক পদ্ধতি অনুসরণ করত। গুপ্ত রাজারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন, যার ফলে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রচন্ড সমৃদ্ধ হয়েছিল। ইতিহাসবিদদের মতে প্রথম কুমারগুপ্ত নালন্দার প্রতিষ্ঠাতা এবং নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণ কার্যে বিদেশী রাজাদের ও অবদান ছিল অসীম, তারাও তাঁদের ইচ্ছা মতো দান করতেন। ঐতিহাসিকদের তথ্য থেকে জানা যায় যে ইন্দোনেশিয়ার রাজা শৈলেন্দ্র নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আবাস তৈরীতে অর্থ প্রদান করেছিলেন। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল শিক্ষার একটি আবাসিক কেন্দ্র এবং এখানে প্রায় ১০ টি মন্দির, শ্রেণীকক্ষ, মেডিটেশন কক্ষ, মঠ, ছাত্রাবাস, ইত্যাদি ছিল এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ১০,০০০ জনেরও বেশি শিক্ষার্থী এবং ২০০০ শিক্ষকদের থাকার ব্যবস্থা ছিল।

১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খিলজির অধীনে তুর্কি মুসলিম আক্রমণকারীরা, যাদেরকে মামলুক বলা হয়, তাদের দ্বারা নালন্দা লুটপাট ও ধ্বংস হয়েছিল। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহান গ্রন্থাগারটি এতটাই বিশাল ছিল যে এতে ৯ কোটির ও বেশি পাণ্ডুলিপি রাখা ছিল, ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন তিব্বতীয় পুঁথি অনুসারে জানা যায়, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারটি তিনটি বড় বহুতল ভবনে বিস্তৃত ছিল। এই ভবনগুলির মধ্যে একটিতে নয়টি তলা ছিল যেখানে সবচেয়ে পবিত্র পাণ্ডুলিপি গুলি রাখা থাকতো। হানাদাররা ভবনে আগুন দেওয়ার পর তিন মাস ধরে লাইব্রেরি পুড়েছিল। মুসলিম হানাদাররা মঠগুলো ধ্বংস করে এবং ভিক্ষুদের ঐ স্থান থেকে তাড়িয়ে দেয়।

পারস্যের ঐতিহাসিক, মিনহাজ-ই-সিরাজ তাঁর তাবাকাত-ই নাসিরি গ্রন্থে  কয়েক দশক পরে এই সমস্ত কর্মকান্ড লিপিবদ্ধ করেন। ঐতিহাসিকদের মতে বখতিয়ার খিলজি বিহারে ধারাবাহিক লুণ্ঠন অভিযান শুরু করেন এবং তিনি তাঁর ঊর্ধ্বতনদের দ্বারা তাঁর কর্মকাণ্ডের জন্য সম্মান লাভ করেন ও পুরস্কৃত হন। 


পৃথিবীর বুকে আজ এই গ্রন্থাগার গুলি না থাকলেও তাদের প্রাচীন গরিমা আজও বর্তমান। আমরা যারা জ্ঞান আহরণ করতে অজানা কে জানতে ভালোবাসি, সকলেই চেষ্টা করি বর্তমান সময়ে বিভিন্ন গুরুত্ব নথিপত্র কম্পিউটারে পিডিএফ করে রাখতে। হয়তো ভবিষ্যতে আরো নতুন কোন পদ্ধতি অবশ্যই আবিষ্কার হবে যার মধ্যে দিয়ে আমরা আমাদের সৃষ্টিকর্ম কে অমর করে রাখতে পারব, যা পরবর্তী গবেষকদের সমৃদ্ধ করবে।

কলমে :- Monojit Dey Sarkar 



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

মধ্যযুগে ভেনিসিয়ান ডুকাটের মাধ্যমে বাণিজ্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছিল!!

মধ্যযুগের বাণিজ্য (Artist :- Unknown) মুদ্রা সংগ্রহ এবং সংরক্ষণের নেশা বহু মানুষেরই রয়েছে। সেই মুদ্রা সংগ্রহ কেউ মিন্ট মার্ক অথবা কেউ ইতিহাসের সময়কাল ধরে করে থাকেন। বিশেষ করে যারা বিদেশ ভ্রমণে যান, ভ্রমণের পর, অবশিষ্ট বৈদেশিক অর্থ মানি এক্সচেঞ্জের অফিসে পরিবর্তন করে থাকেন। তবে ইতিহাস পর্যালোচনা করলে লক্ষ্য করা যায়, প্রাচীন সময়ে বৈদেশিক অর্থ বিনিময় একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা রূপে পরিচিত ছিল। বিশেষ করে মধ্যযুগে যখন নতুন নতুন ভূখণ্ড আবিষ্কার হতে থাকে তখন সেই সব ভূখন্ডের সম্পদের প্রতি মানুষের তীব্র আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদার জন্য ব্যাপকভাবে বাণিজ্য শুরু হয়, এবং মধ্যযুগের বাণিজ্যের দিক থেকে ভেনিস ছিল সকলের থেকে এগিয়ে, তাদের এক ধরনের বিশেষ মুদ্রা "ভেনেসিয়ান ডুকাট" ভারতেও প্রবেশ করেছিল ব্যাপক হারে। প্রধানত দক্ষিণ ভারতে এই ডুকাট খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। 2011 সালে তিরুবনন্তপুরমের পদ্মনাভস্বামী মন্দিরের যখন গুপ্ত ভল্ট গুলির একটি খোলা হয়েছিল, তখন সেখানে অন্যান্য ধন-সম্পদের সাথে ব্যাপকভাবে সোনার ডুকাট পাওয়া গিয়েছিল।  কিন্তু কী ভাবে ভিনিসিয়ান ডুকাট এত মূল্যবান হয়েছিল আজ সেই গল্পই আপ

আপনি কি জানেন !! ভারতের পবিত্র পূণ্য ক্ষেত্রে রয়েছে এক ব্রিটিশ সমাধি।

   লর্ড কর্নওয়ালিসের প্রতিকৃতি (British Museum's Collectio n) আমরা যারা ইতিহাস চর্চা করি, 'লর্ড কর্নওয়ালিস' এই নামটির সাথে সকলেই বিশেষভাবে পরিচিত।  ভারতের পবিত্র পূণ্য ক্ষেত্র বেনারস থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গাজীপুর, এই স্থানে ব্রিটিশ গর্ভনর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিসের সমাধিটি অবস্থিত রয়েছে। ইতিহাস বলে কর্নওয়ালিস সাহেব আমেরিকার প্রথম রাষ্ট্রপতি জর্জ ওয়াশিংটনের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন। কিন্তু তার এই পরাজয় জীবনকে থামিয়ে দেয় নি বরং পরবর্তীতে ভারতে বহু যুদ্ধে জয়লাভ করতে সাহায্য করেছিল। অনেক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্যে তিনি ব্রিটিশ সরকারের একজন শক্তিশালী প্রতিনিধি হতে পেরেছিলেন। ভারতের বেনারস বা বারাণসীতে তাঁর সমাধিটি লাড সাহাব বা লাত সাহাব বা লর্ড সাহাব কা মাকবারা নামে পরিচিত। আমেরিকাতে যুদ্ধে পরাজয়ের পর তিনি ভারতবর্ষে আসেন। ১৭৮৬ সালে ভারতে লর্ড কর্নওয়ালিস দ্বিতীয় গভর্নর জেনারেল এবং কমান্ডার-ইন-চীফ হিসেবে কর্মে যোগদান করেছিলেন। খুব দক্ষতা এবং কৌশলের মাধ্যমে তিনি ব্রিটিশদের সম্পর্কে ভারতবাসীর তীব্র ঘৃণাটাকে কিছুটা হলেও দূর করবার চেষ্টা করেছিলেন এবং নিজ